Gallery

ইসলামী আইনে নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে কেন পুরুষের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তি লাভ করে ?



পবিত্র কুরআনে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির বন্টন সম্পর্কে সুনিদৃষ্টভাবে ও বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে , কারা কতটুকু পাবে তাও উল্লেখ করা আছে ।

উত্তরাধিকার সম্পত্তির বন্টন সম্পর্কিত আয়াতসমূহ হল

সূরা বাকারাহ, ২:১৮০

সূরা বাকারাহ, ২:২৪০

সূরা নিসা, ৪:৭-৯

সূরা নিসা, ৪:১৯

সূরা নিসা, ৪:৩৩

সূরা মায়িদাহ, ৫:১০৬-১০৮

কুরআনে তিনটি আয়াত রয়েছে যেখানে সবিস্তারে ও স্পষ্টভাবে নিকটাত্মীয়দের সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে; সূরা নিসা, চতুর্থ সূরা, ১১,১২ ও ১৭৬ নম্বর আয়াতে। আয়াতসমূহের বাংলা অনুবাদ উল্লেখ করা হল :

“আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তান সম্পর্কে আদেশ করেন ; একজন পুরুষের অংশ দুজন নারীর অংশের সমান। অতঃপর যদি শুধু নারীই হয় দুই এর অধিক, তবে তাদের জন্যে ঐ মালের তিন ভাগের দুই ভাগ, এবং যদি একজনই হয় তবে তার জন্যে অর্ধেক। মৃতের পিতা মাতার মধ্যে থেকে প্রত্যেকের জন্যে ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের পুত্র থাকে। যদি পুত্র না থাকে এবং পিতা মাতাই ওয়ারিশ হয়, তবে মাতা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। অতঃপর যদি মৃতের কয়েকজন ভাই থাকে, তবে তার মাতা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ, ওসিয়্যতের পর, যা করে মরেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রের মধ্যে কে তোমাদের অধিক উপকারী তোমরা জান না। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, পরম কুশলী।

আর,তোমাদের হবে অর্ধেক সম্পত্তি যা ছেড়ে যায় তোমাদের স্ত্রীরা যদি তাদের কোনো সন্তান না থাকে। যদি তাদের সন্তান থাকে তবে তোমাদের হবে এক-চতুর্থাংশ ঐ সম্পত্তির,যা তারা ছেড়ে যায়, ওসিয়্যতের পর, যা তারা করে এবং ঋণ পরিশোধের পর। স্ত্রীদের জন্যে এক-চতুর্থাংশ হবে ঐ সম্পত্তির, যা তোমরা ছেড়ে যাও যদি তোমাদের কোনো সন্তান না থাকে । আর যদি তোমাদের সন্তান থাকে, তবে তাদের জন্যে হবে ঐ সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ, যা তোমরা ছেড়ে যাও ওসিয়্যতের পর, যা তোমরা কর এবং ঋণ পরিশোধের পর। যে পুরুষের ত্যাজ্য সম্পত্তি, তার যদি পিতা পুত্র কিংবা স্ত্রী না থাকে এবং এই মৃতের এক ভাই কিংবা এক বোন থাকে, তবে উভয়ের প্রত্যেকে ছয় ভাগের এক ভাগ পাবে। আর যদি ততোধিক থাকে, তবে তারা এক তৃতীয়াংশ অংশীদার হবে ওসিয়্যতের পর, যা করা হয়, অথবা ঋণের পর এমতাবস্থায় যে, অপরের ক্ষতি না করে। এ বিধান আল্লাহর। আল্লাহ সর্বজ্ঞ,সহনশীল।”

[সূরা নিসা ৪:১১-১২]

“মানুষ আপনার নিকট ফতোয়া জানতে চায়, অতএব আপনি বলে দিন, আল্লাহ তায়ালা সে ব্যক্তির (উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ব্যাপারে) তোমাদের তাঁর সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন; যার মাতা পিতা কেউই নেই, আবার তার নিজেরও কোনো সন্তান নেই, (এ ধরণের) কোনো ব্যক্তি যদি মারা যায় এবং সে ব্যক্তি যদি সন্তানহীন হয় এবং তার একটি বোন থাকে, তাহলে সে বোনটি সে (মৃত) ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধাংশের মালিক হবে, অপরদিকে সে যদি নিসন্তান হয়, তাহলে সে তার বোনের (সম্পত্তির) উত্তরাধিকারী হবে, যদি তারা দুজন হয়, তাহলে তারা দুই বোন সেই পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ অংশের মালিক হবে; যদি সে ভাইবোনেরা কয়েকজন হয়, তাহলে মেয়েদের অংশ এক ভাগ ও পুরুষের অংশ দুই ভাগ হবে; আল্লাহ তায়ালা (উত্তরাধিকারের এ আইন কানুন) অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তোমাদের জন্যে বলে দিয়েছেন, যাতে করে তোমরা বিভ্রান্ত হয়ে না পড়ো; আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর ব্যাপারেই সম্যক ওয়াকেফহাল”

[সূরা নিসা ৪:১৭৬]

প্রায় সকল ক্ষেত্রেই, উত্তরাধিকার সূত্রে একজন মহিলা একজন পুরুষের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তি পেয়ে আসছে। কিন্তু, সবসময় তা হচ্ছে না। যখন, মৃত ব্যক্তি কোন পূর্বসূরী কিংবা উত্তরসূরী না রেখে মারা যায়, কিন্তু বৈপিত্রিয় (uterine) ভাই বা বোন বর্তমান, তারা উভয়েই সমান সমান ছয় ভাগের এক ভাগ সম্পত্তির মালিক হবে। যদি মৃত ব্যক্তির সন্তানাদি থাকে, মাতা এবং পিতা উভয়েই সমান সমান অংশ পায় যা হচ্ছে ছয় ভাগের এক ভাগ।

নিদৃষ্ট ক্ষেত্রে, একজন মহিলা একজন পুরুষের থেকে দ্বিগুণ সম্পত্তিও লাভ করে থাকে ।

মৃত ব্যক্তি যদি মহিলা হয় এবং যার কোন সন্তান নেই, ভাই বোন ও নেই, কেবলমাত্র তার স্বামী, পিতা,মাতা জীবিত; সেক্ষেত্রে ,স্বামী সম্পত্তির অর্ধেক অংশ লাভ করে এবং মৃত মহিলার মা তিন ভাগের এক ভাগ, মৃত মহিলার পিতা ছয় ভাগের এক ভাগ লাভ করে। এক্ষেত্রে, মা যে সম্পত্তি লাভ করছে তা পিতার দ্বিগুণ।

একথা সত্য যে, সাধারণত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে, একজন নারী একজন পুরুষের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করে। উদাহরণস্বরুপ :

১ কন্যা পুত্রের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তি লাভ করে

২ স্ত্রী ১/৮ অংশ ও স্বামী ১/৪ অংশ লাভ করে যদি, মৃতের কোন সন্তানাদি না থাকে

৩ স্ত্রী ১/৪ অংশ ও স্বামী ১/২ অংশ লাভ করে যদি, মৃতের কোন সন্তানাদি থাকে

৪ যদি মৃত ব্যক্তির কোন পূর্বসূরী কিংবা উত্তরসূরী না থাকে তাহলে, তার বোন যে সম্পত্তি লাভ করবে তা ভাইয়ের অর্ধেক

ইসলামী আইন অনুসারে, একজন মহিলার কোন অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই, বরং অর্থনৈতিক দায়দ্বায়িত্ব পুরুষের উপর বর্তায়। কোন নারীর বিবাহের পূর্বে তার পিতা অথবা ভাইয়ের দ্বায়িত্ব তার সমুদয় দেখাশোনা করা, থাকা খাওয়া, বাসস্থান, কাপড় এবং অন্যান্য সকল অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণে বাধ্য থাকবে। অপরদিকে বিয়ের পর সেই নারীকে দেখাশোনার সকল দ্বায়িত্ব স্বামীর অথবা সন্তানের উপর। ইসলাম পুরুষকে পরিবারের সকল অর্থনৈতিক চাহিদা ও দায়দ্বায়িত্ব পূরণের ভার অর্পণ করেছে। এবং , এ সকল দ্বায়িত্ব পুরণের জন্যেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনে একজন নারীর তুলনায় একজন পুরুষ দ্বিগুণ অংশ লাভ করে থাকে।

উদাহরণ: একজন লোক এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার সম্পত্তি রেখে মারা গেল। তার দুটি সন্তান রয়েছে; একটি কন্যা সন্তান ও একটি পুত্র সন্তান। পুত্র সন্তান এক লক্ষ টাকার সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করবে এবং কন্যা সন্তান লাভ করবে পঞ্চাশ হাজার টাকার সম্পত্তি।

এক লক্ষ টাকা লাভ করার পর পুত্র সন্তানের দ্বায়িত্ব হল, তার পরিবারকে দেখাশোনা করা, এ কাজে তার পুরো সম্পত্তি খরচ হয়ে যেতে পারে অথবা উদাহরণস্বরুপ আশি হাজার টাকা খরচ হয়ে গেল। ফলে তার নিজের জন্য কেবল মাত্র বিশ হাজার টাকার সম্পত্তি অবশিষ্ট রয়ে গেল।

অপরদিকে, কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে যে কিনা পঞ্চাশ হাজার টাকার সম্পত্তি লাভ করলো সে ইসলামী আইন অনুসারে, অন্য কারো জন্য একটি পয়সাও খরচ করতে বাধ্য নয়। সে তার নিজের জন্য পুরো পঞ্চাশ হাজার টাকাই রেখে দিতে পারে।

আপনিই বলুন, আপনি কি এক লক্ষ টাকার সম্পত্তি লাভ করতে চাইবেন যখন জানবেন এর অধিকাংশই, উদাহরস্বরুপ; আশি হাজার টাকা কিংবা পুরোটাই খরচ হয়ে যাবে, নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকার সম্পত্তি লাভ করতে চাইবেন যখন পুরো পঞ্চাশ হাজার টাকাই আপনি নিজের জন্য রেখে দিতে পারবেন ?

_______________________________________________

আরো বিস্তারিতভাবে এখানে আলোচনা করা হল :

ইসলামি উত্তরাধিকার বিধানের বৈশিষ্ট্য ও মূলনীতি:

ইসলামি উত্তরাধিকার বিধানে নারীর অধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে ইসলামি উত্তরাধিকারের কিছু বৈশিষ্ট্য ও মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। যেহেতু আলোচ্য বিষয়ের সাথে এর যোগসূত্র রয়েছে তাই আলোচানা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এতে অনেক সংশয়েরও অবসান ঘটবে।

প্রথমত:

ইসলাম সুষম বন্টনে বিশ্বাসী–সম বন্টনে নয় : অবস্থা ও অবস্থান ভেদে মানুষের প্রকৃতিগত প্রয়োজন ও চাহিদা ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন ধরা যাক সরকারি তহবিল থেকে বন্টনের জন্য কিছু জিনিস আসলো। বন্টনের ক্ষেত্রে দেখা গেলো এক পরিবারে দশ জন সদস্য অন্য পরিবারে মাত্র দুইজন। বিবেকবান মাত্রই এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবে, সমান অধিকারের নামে উভয়জনকে সমপরিমাণ দেওয়া কোন মতেই ন্যায় বিচার হবে না। বরং এক্ষেত্রে ন্যায় বিচার হবে প্রয়োজনানুসারে বন্টন করা। যাকে বলা হয় সুষম বন্টন। তেমনিভাবে ইসলাম সমবন্টনকে ইনসাফের মূল ভিত্তি মনে করে না বরং ইসলাম মনে করে সুষম বন্টনই ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের মূল ভিত্তি। এর আলোকে বন্টনের ক্ষেত্রে কখনো সমান হবে, আবার কখনো অবস্থা ভেদে বিশাল পার্থক্য হতে পারে। উত্তরাধিকার বিধানেও ইসলাম এ নীতিকেই অবলম্বন করেছে।

দ্বিতীয়ত :

ইসলামের উত্তরাধিকার আইন পুরুষ বা নারী কেন্দ্রিক নয়,তেমনিভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদের অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নারী–পুরুষের ব্যবধানও মূখ্য বিষয় নয়। সুতরাং একথা বলার সুযোগ নেই যে ইসলামি উত্তরাধিকার আইন পুরুষকেন্দ্রিক বা নারীকেন্দ্রিক।

তৃতীয়ত:

অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিনটি দিককে সামনে রাখা হয় :

১. মৃত ব্যক্তির সাথে ওয়ারিসের নিকটাত্মীয়তা। যে ওয়ারিস মৃত ব্যক্তির যত কাছের আত্মীয় হবে তার অংশ তত বেশী হবে। যেমন ভাই-বোনের তুলনায় ঔরসজাত সন্তানেরা বেশি পাবে এবং এটিই ইনসাফের দাবী।

২. নতুন প্রজন্ম বা বংশধর প্রবীণদের তুলনায় বেশি পাবে। যেমন সন্তান-সন্ততি পিতা মাতার তুলনায় বেশী পাবে এবং এটিই যুক্তির দাবী। যেহেতু নতুনদের সামনে রয়েছে ভবিষ্যতের এক বিশাল জীবন।

৩. আর্থিক প্রয়োজনীয়তা ও সামাজিক দায়ভার: অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি লক্ষণীয় দিক হলো অংশীদার ওয়ারিসের সামাজিক দায়ভার ও আর্থিক প্রয়োজনীয়তা। যেমন একটি পরিবারের সার্বিক খরচ নির্বাহ করার দায়িত্ব পুরুষের। স্ত্রীর ভরণপোষণ,সন্তান-সন্ততিদের খরচ যোগান দান এবং পিতা-মাতার সার্বিক সেবা-শুশ্রূষা এসব তো পুরুষেরই দায়িত্ব। সামাজিক ও নৈতিক কর্তব্য। এসবদিক লক্ষ্য রেখে ইসলাম অংশ নির্ধারণে তারতম্য করেছে। যেমন মেয়ের তুলনায় ছেলের আর্থিক বাধ্য-বাধকতা ও সামাজিক কর্তব্য বেশি। তাই ইসলাম ছেলের জন্য মেয়ের দ্বিগুণ অংশ নির্ধারণ করেছে।

চতুর্থত:

দুর্বলদেরকেও অবহেলা করা হয়নি:

জাহেলি সমাজে নারী ও শিশুকে ওয়ারিস গণ্য করা হতো না,তারা যুদ্ধে যেতে পারে না শুধুমাত্র এই অজুহাতে। এক কথায় দুর্বলের উপর সবলের খবরদারি। কিন্তু ইসলাম সে অমানবিক বৈষম্য দূর করে তাদেরকেও তাদের প্রাপ্য যথাযথভাবে দান করেছে।

পঞ্চমত:

আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় করাও উত্তরাধিকার বিধানের অন্যতম লক্ষ্য,

মিরাছের সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে ইসলাম রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় করার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন :

وأولوا الأرحام بعضهم أولى ببعض في كتاب الله

আর রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়রা একে অপরের কাছে আল্লাহর কিতাবের ঘোষণা মতে অধিক হক্বদার।

নারীর উত্তরাধিকার:

পূর্বেই আলোচিত হয়েছে, ইসলামি উত্তরাধিকার আইন ন্যায়বিচার ও সুষম বন্টনের উপর প্রতিষ্ঠিত।

বিশেষত: নারীর উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ইসলাম যুগান্তকারী ও ন্যায়সঙ্গত বিধান দিয়েছে।

যেখানে প্রাচীন রোমান সমাজে নারী একজন স্ত্রী হিসেবে কোন অংশ পেত না।
ইহুদি বিধানে ছেলে থাকা অবস্থায় নারীর কোন ধরনের অংশ নেই।

আর ইসলামের আবির্ভাব পূর্ব জাহেলি সমাজের দিকে একটু দৃষ্টি দিলে ভেসে উঠে মায়ের জাতি-নারীর করুণ চিত্র। সম্পদে তার উত্তরাধিকার তো দূরের কথা বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ নারীকেই মিরাছের সম্পদ হিসেবে পরিগণিত করা হতো। কুরআনুল কারিমে নারীর নামে নামকরণকৃত সূরা আন নিসার ১৯ নং আয়াত

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَرِثُوا النِّسَاءَ كَرْهًا

হে ঈমানদারগণ, তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে তোমরা জোরপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারি হবে।

এ করুণ বাস্তবতা ইঙ্গিত বহন করে, অন্যান্য সাধারণ অবস্থায় নারীকে সমাজের বোঝা মনে করা হতো। যুদ্ধে যেতে পারে না, জাতীয় অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারে না, এ জাতীয় অজুহাত দেখিয়ে নারীকে সম্পূর্ণভাবে মিরাছের সম্পদ হতে বঞ্চিত করা হতো। এমন অবস্থায় ইসলাম সার্বজনীন ও কালজয়ী মানবিক বিধান দিয়ে নারীকে অবহেলা ও লাঞ্ছনার এই অতল গহ্বর থেকে উদ্ধার করে সম্মানের আসনে বসিয়েছে। দেখিয়েছে নতুন করে জীবন চলার আলোকিত পথ। কুরআনের শাশ্বত বাণীতে ঘোষিত হয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে নারীর প্রাপ্তির ঘোষণা।

প্রাপ্তির ঘোষণা:

বিশিষ্ট মুফাসসির সাঈদ ইবনে জুবাইর ও ক্বাতাদাহ (রা) বলেন, ইসলামের পূর্বে মুশরিকরা মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের মাঝেই বন্টন করে দিত। নারী ও শিশুদেরকে কিছুই দিতো না। এরই প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয় সূরা আন নিসার ৭ নং আয়াত :

لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا ﴿7﴾

অর্থ : পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের রেখে যাওয়া সম্পদে পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে এবং নারীদেরও রয়েছে সুনির্দিষ্ট অংশ। তা কম হোক কিংবা বেশি ।

পবিত্র কুরআনের এ ঘোষণার মাধ্যমে নারী উত্তরাধিকার সূত্রে সুনির্দিষ্ট অংশ পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকারই লাভ করলো। এ বিধান কোনো কথিত নারীবাদী আন্দোলনে বাধ্য হয়ে প্রণীত হয়নি। বরং মহান প্রজ্ঞাময় স্রষ্টা মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক অবগত হয়েই তাদের সার্বিক কল্যাণের জন্য এ বিধান দান করেছেন। এভাবেই নারী তার ব্যক্তি মালিকানার অধিকার পেলো। মা, মেয়ে, স্ত্রী, বোন, দাদী, নাতনী হিসেবে নারীর সুনির্দিষ্ট অংশ ঘোষিত হলো। এর বাইরেও বন্টনের পর অবশিষ্টাংশেও বিভিন্ন অবস্থায় রয়েছে নারীর প্রাপ্যাংশ।

• নির্দিষ্ট অংশ পাওয়া নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশী :

ইসলামি উত্তরাধিকার বিধানে নির্দিষ্ট অংশ পাওনাদার ১২ জন ওয়ারিসের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮ জন (মা, মেয়ে, স্ত্রী, ছেলের মেয়ে, সহোদরা বোন, বৈমাত্রেয় বোন, বৈপিত্রেয় বোন, দাদী, নানী) আর পুরুষ হলো ৪ জন, (বাবা, স্বামী, দাদা, মা সম্পর্কীয় ভাই)।

যেখানে ঔরসজাত মেয়ে ও বোনের জন্য নির্দিষ্ট অংশ বন্টন করা হয়েছে এর বিপরীতে ঔরসজাত ছেলে ও ভাইদের জন্য নির্দিষ্ট কোন অংশ নেই ! বরং নির্দিষ্ট অংশধারী ওয়ারিসদের হিসসা বন্টনের পর আসবে তাদের প্রাপ্তির হিসাব।

প্রসঙ্গ:

পুরুষ পাবে নারীর দ্বিগুণ, কখন? এবং কেন?

পবিত্র কুরআনের সূরা আন নিসার ১১ নং আয়াত لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ ছেলে পাবে মেয়ের দ্বিগুণ, এ আয়াত নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশেষত যারা প্রতিনিয়ত ইসলামের দুর্বলতা খুঁজে বের করার নোংরা ব্রতে লিপ্ত। তারা এ আয়াতের মাধ্যমে এ কথা সাব্যস্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে থাকে যে, ইসলাম নারীকে পুরুষের অর্ধেক মনে করে। একটি পূর্ণাঙ্গ সত্তা হিসেবে নারীকে স্বীকৃতি দেয় না। তাই মিরাছের অংশও তাদেরকে পুরুষের অর্ধেক দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ আয়াত যে ইনসাফ ও সুষম বন্টনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারে না।

• দ্বিগুণ পাওয়া সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়,

কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী বিধানটি শুধুমাত্র ছেলে-মেয়ে এবং ভাই-বোনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অথচ নারী বলতে শুধুমাত্র মেয়ে সন্তান বা বোনদেরকে বুঝায় না। এরা ছাড়াও অনেক নারী ওয়ারিস রয়েছে যাদের বিপরীতে পুরুষের দ্বিগুণ পাওয়ার বিধান নেই। এজন্যই এ আয়াতের পরবর্তী আয়াতগুলোতে মা-স্ত্রীসহ অন্যান্য নারী ওয়ারিসদের নির্দিষ্ট অংশের বর্ণনা এসেছে। সেখানেতো পুরুষ নারীর দ্বিগুণ পায়নি। তাছাড়া পুরুষদের পরস্পরের মধ্যেও বিভিন্ন অবস্থায় বিশাল ব্যবধান হয়ে থাকে। বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নারী পুরুষের সমান পাচ্ছে,আবার অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি পাচ্ছে। একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা তুলে ধরলে ব্যাপারটি আরো পরিস্কার হয়ে যাবে আশা করি।

নারী পুরুষের অংশ প্রাপ্তির একটি তুলনামূলক চিত্র:

মিসরের জাতীয় ফতোয়া বোর্ড কর্তৃক প্রচারিত এক ফতোয়ায় মিরাছের সম্পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে নারী পুরুষের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে। তাতে যে বিস্ময়কর তথ্য এসেছে তার মাধ্যমে অনেকের চোখ খুলে যেতে পারে,বিবেক পেতে পারে নতুন খোরাক। ঐ পরিসংখ্যানে নারী কখন পুরুষের অর্ধেক পায়,আর কখন সমান পায়,আর কখন বেশি পায় তার বর্ণনা এসেছে অত্যন্ত পরিস্কারভাবে। লক্ষ্য করুন:

• নারী কেবলমাত্র চার অবস্থায় পুরুষের অর্ধেক পায় :

১. মেয়ে ও নাতনী(ছেলের মেয়ে) ছেলে ও নাতী (ছেলের ছেলে) থাকা অবস্থায়।

২. ছেলে সন্তান ও স্বামী বা স্ত্রী না থাকলে “মা” পিতার অর্ধেক পায় ।

৩. “সহোদরা বোন” সহোদর ভাইয়ের সাথে ওয়ারিস হলে।

৪. “বৈমাত্রেয় বোন” বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সাথে ওয়ারিস হলে।

• ১০ দশ অবস্থায় নারী পুরুষের সমান পায় :

১.পিতা-মাতা সমান অংশ পাবে ছেলের ছেলে থাকলে।

২. বৈপিত্রেয় ভাই-বোন সব সময় সমান অংশ পায়।

৩.বৈমাত্রেয় ভাই-বোন থাকলে সব ধরণের বোনেরা (সহোদরা, বৈপিত্রেয় ও বৈমাত্রেয়) বৈপিত্রেয় ভাইয়ের সমান পাবে।

৪.শুধুমাত্র ঔরসজাত মেয়ে ও মৃতের ভাই একসাথে থাকলে উভয়ে সমান অংশ পাবে। (মেয়ে পাবে অর্ধেক আর বাকী অংশ পাবে চাচা)

৫. “নানী” বাবা ও ছেলের ছেলের সাথে সমান অংশ পায়।

৬. মা ও বৈপিত্রেয় দুই বোন স্বামী ও সহোদর ভাই এর সাথে সমান অংশ পায়।

৭. “সহোদর বোন” স্বামীর সাথে ওয়ারিস হলে সহোদর ভাইয়ের সমান অংশ পাবে। অর্থাৎ সহোদর বোনের পরিবর্তে সহোদর ভাই হলে যে অংশ পেত ঠিক সহোদরাও একই অংশ পাবে। অর্থাৎ মূল সম্পদের অর্ধেক পাবে।

৮. বৈমাত্রেয় বোন সহোদর ভাইয়ের সমান অংশ পায় যদি মৃত ব্যক্তির স্বামী, মা, বৈপিত্রেয় এক বোন এবং একজন সহোদর ভাই থাকে। এ অবস্থায় স্বামী মূল সম্পদের অর্ধেক, মা এক ষষ্ঠাংশ, বৈপিত্রেয় ভাই এক ষষ্ঠাংশ এবং বাকী এক ষষ্ঠাংশ পাবে সহোদর ভাই।

৯. নির্দিষ্ট অংশধারী ওয়ারিস এবং আসাবা সূত্রে পাওয়ার মত কেউ না থাকলে নিকটতম রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়রা সমান অংশ পাবে। যেমন মেয়ের ছেলে, মেয়ের মেয়ে, মামা ও খালা ছাড়া অন্য কোন ওয়ারিস না থাকলে এদের সবাই সমান অংশ পাবে।

১০. তিন প্রকারের মহিলা এবং তিন প্রকারের পুরুষ কখনো সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হয় না। এক্ষেত্রেও নারী পুরুষ সমান অধিকার ভোগ করছে।

• অনেক অবস্থায় নারী পুরুষের চেয়ে বেশী পায়। যেমন,

১. স্বামী থাকা অবস্থায় একমাত্র কন্যা পাবে অর্ধেক আর স্বামী পাবে এক চতুর্থাংশ ।

২. দুই কন্যা স্বামীর সাথে হলে। দুই মেয়ে পাবে দুই তৃতীয়াংশ আর স্বামী এক চতুর্থাংশ।

৩. কন্যা মৃতের একাধিক ভাইয়ের সাথে হলে বেশী পাবে।

৪. যদি মৃত ব্যক্তি স্বামী, বাবা, মা ও দুই কন্যা রেখে যায় তবে দুই মেয়ে দুই তৃতীয়াংশ সম্পদ পাবে। কিন্তু ঠিক একই অবস্থায় যদি মেয়ের পরিবর্তে দুই ছেলে থাকত তবে তারা নিশ্চিত ভাবে দুই মেয়ের তুলনায় কম পেত। কেননা ছেলের অংশ হলো এখানে অন্যান্য ওয়ারিসদেরকে তাদের নির্ধারিত অংশ দেওয়ার পর যা বাকী থাকে। সুতরাং স্বামী পাবে এক চতুর্থাংশ, বাবা ও মা উভয়ে পাবে এক ষষ্ঠাংশ করে এবং বাকী অংশ পাবে দুই ছেলে যা দুই তৃতীয়াংশ তো নয়ই বরং অর্ধেকের চেয়েও কম।

৫. ঠিক একই ধরণের আরেকটি অবস্থা দুই সহোদর বোনের ক্ষেত্রে। যদি ওয়ারিসদের মধ্যে স্বামী, দুই সহোদর বোন এবং মা থাকে তখন দুই বোন দুই তৃতীয়াংশ সম্পদ পায়। কিন্তু ঠিক একই অবস্থায় যদি দুই বোনের জায়গায় দুই ভাই থাকত তখন ঐ দুই ভাই মিলে এক তৃতীয়াংশের বেশি পেত না।

৬. তেমনি ভাবে একই অবস্থায় বৈমাত্রেয় দুই বোন বৈমাত্রেয় দুই ভাইয়ের চেয়ে বেশী পায়।

৭. অনুরূপভাবে যদি ওয়ারিসদের মধ্যে স্বামী, বাবা, মা ও মেয়ে থাকে তবে মেয়ে মূল সম্পদের অর্ধেক পাবে। কিন্তু ঠিক একই অবস্থায় ছেলে থাকলে পেত তার চেয়ে কম। যেহেতু তার প্রাপ্যাংশ হলো অংশীদারদেরকে দেওয়ার পর অবশিষ্টাংশ।

৮. ওয়ারিস যদি হয় স্বামী, মা ও এক সহোদর বোন তখন ঐ সহোদর বোন অর্ধেক সম্পদ পাবে যা তার স্থানে সহোদর ভাই হলে পেত না।

৯. ওয়ারিস যদি হয় স্ত্রী, মা, বৈপিত্রেয় দুই বোন এবং দুই সহোদর ভাই তখন দূরের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও বৈপিত্রেয় দুই বোন দুই সহোদরের চেয়ে বেশী পাবে। যেহেতু বৈপিত্রেয় বোনদ্বয় পাবে এক তৃতীয়াংশ, আর দুই সহোদর পাবে অবশিষ্টাংশ যা এক তৃতীয়াংশের চেয়েও কম।

১০. যদি স্বামী, বৈপিত্রেয় বোন ও দুই সহোদর ভাই থাকে সে ক্ষেত্রে বৈপিত্রেয় বোন এক তৃতীয়াংশ পাবে। অথচ এই দুই সহোদর অবশিষ্টাংশ থেকে যা পাবে তা ঐ বোনের এক চতুর্থাংশেরও কম।

১১. ওয়ারিস যদি হয় বাবা, মা ও স্বামী এ ক্ষেত্রে ইবনে আব্বাস (রা) এর মত অনুসারে মা পাবে এক তৃতীয়াংশ, আর বাবা পাবে এক ষষ্ঠাংশ অর্থাৎ মায়ের অর্ধেক।

১২. স্বামী, মা, বৈপিত্রেয় বোন ও দুই সহোদর ভাই ওয়ারিস হলে এক্ষেত্রে ঐ বোন দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও সহোদর ভাইদ্বয়ের দ্বিগুণ পাবে।

• অনেক সময় নারী মিরাছ পায় কিন্তু তার সমমানের পুরুষ বঞ্চিত হয় । যেমন,

১. ওয়ারিস যদি হয় স্বামী, বাবা, মা, মেয়ে ও নাতনী (ছেলের মেয়ে) এক্ষেত্রে নাতনী এক ষষ্ঠাংশ পাবে। অথচ একই অবস্থায় যদি নাতনীর পরিবর্তে নাতী (ছেলের ছেলে) থাকত তখন এই নাতী কিছুই পেত না। যেহেতু নির্ধারিত অংশীদারদেরকে দিয়ে অবশিষ্টাংশই তার প্রাপ্য ছিলো। অথচ এ অবস্থায় কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তাই তার প্রাপ্তির খাতাও থাকে শূন্য ।

২. স্বামী, সহোদর বোন ও বৈমাত্রেয় বোন থাকা অবস্থায় বৈমাত্রেয় বোন এক ষষ্ঠাংশ পাবে। অথচ তার স্থানে যদি বৈমাত্রেয় ভাই থাকতো তবে সে কিছুই পেত না, যেহেতু তার জন্য নির্ধারিত অংশ নেই।

৩. অনেক সময় দাদী মিরাছ পায়, কিন্তু দাদা বঞ্চিত হয়।

৪. মৃত ব্যক্তির যদি শুধুমাত্র নানা ও নানীই ওয়ারিস হিসেবে থাকে তখন সব সম্পত্তি পাবে নানী। নানা কোন কিছুই পাবে না।

এরপরও কি বলা হবে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে ঠকিয়েছে?

এ তুলনামূলক আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো এ বাস্তবতাকে সাব্যস্ত করা যে,

এক. নারী পুরুষের অর্ধেক পায় এই বিধান সব সময়ের জন্য নয়।

দুই. অংশ পাওয়ার ক্ষেত্রে নারী কোন অংশেই পুরুষের চেয়ে কম নয়।

সুতরাং অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বিভাজন টানা নিতান্তই অজ্ঞতার পরিচায়ক।

• ছেলে কেন মেয়ের অর্ধেক পায় ?

এখানে জোরালো একটি প্রশ্ন থেকে যায় আর তা হচ্ছে ছেলে থাকা অবস্থায় “মেয়ে”, ভাই থাকলে “বোন” কেন তার অর্ধেক পাবে? তার মানে কি মেয়ে-সন্তান ছেলে-সন্তানের অর্ধেক মর্যাদা রাখে? এ সংশয় নিরসনের পূর্বে স্মরণ করা প্রয়োজন যে ইসলামি উত্তরাধিকার বিধানে নারী-পুরুষের বিভাজনটি মৌলিক কোন লক্ষণীয় বিষয় নয়। বরং সামাজিক দায়ভার ও আর্থিক প্রয়োজনীয়তার কারণেই সাধারণত প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তফাৎ হয়ে থাকে।

ছেলে সন্তান মেয়ের দ্বিগুণ পাওয়ার অনেক গুলো যৌক্তিক কারণের মধ্যে কয়েকটি হলো,

১. পারিবারিক দায়িত্ব:

পরিবারের কর্তা হিসেবে সব খরচপাতি বহন করতে হয় ছেলেকে। পিতা-মাতার খেদমত, সন্তান-সন্ততির লালনপালন এবং আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ খবর নেওয়ার দায়িত্বও মূলত পুরুষের উপরই অর্পন করেছে ইসলাম। বিপরীতে মেয়ে এসব দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। তারপরও ইসলাম তাকে বঞ্চিত করেনি।

২. স্ত্রীর যাবতীয় অধিকার:

দাম্পত্য জীবনে প্রবেশের পথে পুরুষকে গুণতে হয় স্ত্রীর দেনমোহর বাবদ একটি মোটা অংকের কড়ি। আর বিয়ের পর স্ত্রীর ভরণপোষণ ও যাবতীয় খরচপাতিও এই পুরুষকেই বহন করতে হয়। পক্ষান্তরে মেয়ে বিয়ের আগে থাকে পিতার তত্বাবধানে। তার আদর সোহাগে বড় হয়। বিয়ের সময় স্বামীর কাছ থেকে দেনমোহর পায়। তারপর তার ভরণপোষণের যাবতীয় দায়িত্ব স্বামীর। সাংসারিক খরচ বাবদ একটি পয়সাও তাকে ব্যয় করতে হয় না। সবই স্বামীর দায়িত্ব। তাই তার প্রাপ্ত সম্পদের মূলধন কখনো হ্রাস পায় না। এরপরও তো ইসলাম তাকে বঞ্চিত করেনি। বরং ইসলাম তার সম্পদকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে।

এসব যৌক্তিক কারণে ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের দাবী হলো ছেলেকে মেয়ের চেয়ে বেশী দেওয়া।

যেহেতু ইনসাফ বা ন্যায় বিচার হলো সুষম বন্টন,সমান বন্টন নয়।

পরিশেষে সত্য উচ্চারণ করে বলতে হয় – ইসলামের উত্তরাধিকার বিধান একটি মানবিক ও ন্যায়সঙ্গত বিধান। যেখানে প্রত্যেক শ্রেণীর ওয়ারিসের তার উচিত প্রাপ্যাংশ লাভের নিশ্চয়তা রয়েছে। সত্য উপলব্ধিকারী অমুসলিম চিন্তাবিদ Gostaf Lobon ইসলামি উত্তরাধিকার বিধানকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে :

কুরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকার বিধান বড়ই ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক। এ বিধানকে ফরাসি ও ব্রিটিশ আইনের সাথে তুলনা করে আমার কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে ইসলামি শরিয়া বা বিধান স্ত্রীদেরকে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এমন সব অধিকার দিয়েছে যার কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না আমাদের আইনসমূহে।

হ্যাঁ,আল্লাহর দেওয়া বিধানের তুলনা কোন মানব রচিত বিধানের সাথে চলেনা। আল্লাহর আইন সর্বকালের, সর্বস্থানের এবং সকলের জন্য। আর আল্লাহর আইন অনুসরণেই রয়েছে মানবাতার মুক্তি, শান্তি ও সাফল্যের নিশ্চয়তা।

রেফারেন্সঃ ইসলামিক রিসার্চ ফাউণ্ডেশন।

Leave a comment